Inactivity এর বাংলা করলে দাঁড়ায় – নিষ্ক্রিয়তা।
এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। 2002 সাল থেকে 2021, এই সময়কালের মধ্যে মানুষ কী পরিমান অলস হয়েছে ইউরোপে, তা গবেষণা করতে গিয়ে দেখতে পেল যে – ইউরোপে মানুষ আগের চেয়ে 20 পার্সেন্ট বেশি অলস হয়ে গেছে।
কিন্তু কেন অলস হয়ে উঠেছে?
অলসতার কারণ – নিষ্ক্রিয়তা।
কিন্তু কি কারনে তাহলে নিষ্ক্রিয়?
এই শতকে একটি মাত্র জিনিস মানুষকে এতটা অলস করে দিয়েছে। সেটি হল – মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোন! মোবাইল ফোন!
মানুষ এখন টিভির চেয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে বেশি অথবা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে অনেক বেশি।
এক গবেষণায় দেখা গেছে – গড়ে মানুষ এখন দৈনিক সাড়ে তিন ঘন্টা থেকে সাড়ে চার ঘন্টা মোবাইল ফোনে কাটায়।
গড়ে একটি মানুষ দিনে 58 বার মোবাইল ফোনটি হাতে নেয়।
প্রেম ট্রেম করলে তো কথাই নেই! উঠতে-বসতে ফোন-কেও হয়তো চুমু খায়।
প্রতিদিন তিন ঘন্টার উপর ধরলেও বছরে একটি মানুষ 50 দিন মোবাইল ফোনে কাটায়।
সে হিসেবে বছরে বারমাসের প্রায় দুই মাস কেটে যায় মোবাইল ফোন দেখে দেখে। জীবনের আর কী বাকী থাকে। আধুনিক মানুষের অদ্ভুত সব ব্যাপার স্যাপার।
স্মার্টফোন মানুষকে কি আসলেই স্মার্ট করে তুলেছে! নাকি মানুষ আগের চেয়ে আরো বেশি আনস্মার্ট জীবন যাপন করছে।
যন্ত্রের সামনে বসে থাকতে-থাকতে মানুষের এই নিষ্ক্রিয়তা শরীরকেও খেয়ে ফেলে।
যন্ত্রের আনন্দে বিভোর থাকে বলে শরীরের যন্ত্রণা ভুলে থাকে। কিন্তু যন্ত্র থেকে উঠিয়ে নিলে শরীর যে যন্ত্রনা শুরু করে, সেটা আবার কাটাতে পারে না।
দেখা গেছে 30 থেকে 45 বছর বয়সের লোকেরা বেশি সময় এখন মোবাইল ফোনে কাটায়। কিশোর তরুণরাও এখন একই অনেক সময় দেয় ফোনে। অথচ কিশোর-তরুণদের আরো বেশি উদ্দাম এবং শারীরিক অ্যাকটিভিটিতে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল।
মানুষ এখন গড়ে তিন ঘন্টা করে সময় দিলে তার দেড় ঘণ্টায় দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আর ঠিক এই কারনে এখন দেখা গেছে যে- 40 এর আগেই অনেকের শরীরে ডায়াবেটিস এবং হার্টের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে।
সারা পৃথিবীতে এখন প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি এগারোজনে একজনের ডায়াবেটিস। প্রায় 500 মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিস আক্রান্ত পৃথিবীতে। মানুষের সংখ্যা 8 বিলিয়ন, প্রায় ছয় বিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক।
বাংলাদেশে এখন 7 মিলিয়ন বা 70 লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। 18 কোটি মানুষের মধ্যে 12 কোটি মানুষ হল প্রাপ্তবয়স্ক। এই 12 কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় এক কোটির কাছাকাছি লোকই ডায়াবেটিস আক্রান্ত।
পাশের দেশ ভারতেও প্রায় 80 মিলিয়ন লোক ডায়াবেটিস আক্রান্ত এখন।
সাথে কম বয়সে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মারা যায় এখন হার্টের বিভিন্ন ধরনের সমস্যায়।
ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফোনের অলস জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটিশরা। গবেষণায় দেখা গেছে যে – ব্রিটিশ জনগণ গড়ে 3 ঘন্টা 15 মিনিট প্রতিদিন ফোনের পেছনে ব্যয় করে। শুধু ফোন নিয়ে অযথা বসে থাকার কারণে বছরে প্রায় 80 হাজার এর উপরে মৃত্যু হয়। সারা পৃথিবীতে এরকম অলসতার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে এখন মিলিয়নের মতো।
পশ্চিমে সরকারগুলো শিশু কিশোরদের দৈনিক দেড় ঘণ্টার বেশি ফোনে সময় না দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশ লোকজন গড়ে 4 ঘন্টার উপরে ফোনে সময় দেয়। 5 ঘন্টার উপরে সময় দেয় 28% এর মতো। এমনকি ছয় ঘন্টার উপরেও সময় দেয় 12 পার্সেন্ট এর মতো। তার মধ্যে আবার দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
ফোনের পেছনে এই নিষ্ক্রিয়তা কিডনি থেকে শুরু করে ডিপ্রেশন, আর্থ্রাইটিস থেকে শুরু করে হজম সমস্যা, ইমিউনিটি থেকে কার্ডিয়াক সমস্যা, কত কিছুতেই যে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, নিজেরাই জানেনা।
তাহলে কি করবেন?
• ফোনের ব্যবহার কমিয়ে দিন।
• নিজেকে অ্যাক্টিভ করুন এবং অ্যাক্টিভ রাখুন।
• দৈনন্দিন জীবনে পরিশ্রমের কাজ বাড়িয়ে দিন।
• সে সুযোগ কম থাকলে ব্যায়াম করুন, হাঁটুন।
• ঘরে মহিলারা কাজের লোকের উপর নির্ভর না করে নিজ হাতে কাজ করুন।
• ফোনে বেশি অলস সময় না দিয়ে প্রিন্ট ফরমেটে ভালো একটি বই পড়ুন, গান শুনুন, প্রকৃতির কাছে যান, বাগান করুন।
• সামাজিক সাক্ষাতে গল্প করুন, ফোনে নয় সাক্ষাতে কথা বলুন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি অসামাজিক করে তুলেছে। সামাজিক শব্দটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে সবচেয়ে বেশি অসামাজিক করেছে মিডিয়াগুলো। এই দানবদের হাত থেকে বেরিয়ে আসুন।
অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপেল, দুটোই একটি সিস্টেম রেখেছে তাদের প্রডাক্টগুলোতে এখন। সেটি হলো – স্ক্রিন টাইম।
আপনি কত সময় স্ক্রিনে সময় কাটাচ্ছেন, তার একটি সাপ্তাহিক হিসাব দেবে আপনাকে।
আমি নিজে এটি ব্যবহার করি। কতটা সময় আমি অপব্যয় করছি এখানে, তা বুঝতে পারি এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
সপ্তাহে আমার স্ক্রিন টাইম সাড়ে ছয় থেকে আট ঘণ্টা মাত্র। সে হিসাবে দৈনিক আমি 50 থেকে 60 মিনিটের বেশি ফোনে সময় দেই না। ধরে নিলাম গড়ে এক ঘন্টা।
ফেসবুকে লেখালেখি করি। শুধু আমার লেখাটি লিখতেই এখানে আসি। মুখে মুখে ছোট ছোট লেখা লিখি বলে বেশি সময় লাগেনা। এমনকি এই লেখাটিও ফোনে কফি খেতে খেতে মুখে মুখেই লিখছি। সামাজিক মাধ্যমে খুব কম মানুষের লেখা পড়ি। তারচেয়ে বড় কথা – স্বাস্থ্যকে এবং শরীরকে নিরাপদ রাখি। সেটাই জরুরি। নিজেকে উদাহরণ দিয়ে নিজের কথাগুলো এই কারণেই বলা। অ্যাক্টিভ থাকি। নিজ হাতে ঘরের কাজগুলো করি। কাজে কিংবা শপিং বা দূরে ঘুরতে যাওয়া ছাড়া কোথাও ড্রাইভ করি না। এরচেয়ে পায়ে হেঁটে যাই। কখনও হাঁটতে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে অডিও বুক শুনি। সেইভ করতে করতে সকালের নিউজটি শোনা হয়ে যায়। টিভি দেখি না তেমন । গোসল করতে করতে দিনের সবচেয়ে আনন্দময় গানটি শুনে ফেলি। রান্নাঘরে খাবারের আয়োজনে মেতে উঠলে কোন একটি ইন্টারেস্টিং ডিসকাশন ছেড়ে দেই, পডকাস্ট -এ আলোচনা শুনি। গুণী লোকদের লেকচার শুনি। সময় পেলে TED লেকচারে 20 মিনিটের মজার কোনো আলোচনা শুনে নেই।
কাজের সময় কাজ, পরিশ্রমের সময় পরিশ্রম, বিনোদনের সময় বিনোদন, ঘুমের সময় ঘুম।
ফোনে সময় দেয়াটুকু নিয়ন্ত্রণ করুন । সামাজিক মাধ্যমে নিজের পছন্দের একটি বলয় তৈরি করুন। ভালো কোন লেখা পেলে মনোযোগ সহকারে পড়ুন। অনেক আবর্জনা এবং অপ্রয়োজনীয় লেখা পড়ে চোখ এবং মাথা নষ্ট না করুন।
শরীর এবং মন দুটোই ভাল থাকবে।
একমুখী কোন কিছুই ভালো নয়। ভারসাম্যের আরেক নাম জীবন।
সূত্র
1. The End of Absence – Michael Harris
2. Marketwatch
3. PsychCentral
4. The Guardian
5. King Juan Carlos University, Spain – Prof. Xian Mayo Mouriz
© অপূর্ব চৌধুরী। চিকিৎসক এবং লেখক।